রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫, ০৯:০২ অপরাহ্ন
শিরোনাম :

‘স্বাধীন’ রাখাইন রাষ্ট্রে রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ

রিপোর্টার :

সংবাদটি শেয়ার করুন....

 

গত সপ্তাহের কলামে লিখেছিলাম, সিত্তয়ের পতনের পর রাখাইন স্বাধীন হোক বা মিয়ানমারের সঙ্গে কনফেডারেশনে থাকুক, বাংলাদেশের তিনটি প্রধান অগ্রাধিকারের অন্যতম হচ্ছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। কারণ, নিপীড়িত এই জনগোষ্ঠীর একটি অংশ ইতোমধ্যে স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সামরিক জান্তার সঙ্গে যোগ দিয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে। বুথিডং শহর ও মংডু সেনাছাউনি পতনের পর তারাও আটক বা হত্যাকাণ্ডেরও শিকার হয়েছে (রাখাইনে স্বাধীন রাষ্ট্রের সম্ভাবনা ও বাংলাদেশের করণীয়/ শেখ রোকন/সমকাল, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪)। গত কয়েক মাসে রাখাইন থেকে নতুন করে ৬০ থেকে ৮০ হাজার রোহিঙ্গা নানাভাবে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রিত ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।

ওদিকে, সীমান্তের অপর পাশে, গত এক সপ্তাহে পরিস্থিতির ওপর সামরিক জান্তার নিয়ন্ত্রণ আরও দুর্বল হয়েছে। রাখাইনের ১৭টি টাউনশিপ বা জেলার মধ্যে ১৪টিই এখন আরাকান আর্মির হাতে; বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অপর রাজ্য চিন স্টেটেরও ৯টি টাউনশিপের ৭টিই জান্তামুক্ত– জান্তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে কেবল হাখা ও থান্টলং টাউনশিপ (নারিনজারা নিউজ, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪)। তবে, রাখাইন স্টেটের রাজধানী সিত্তয়েসহ তিনটি টাউনশিপ এবং চিন স্টেটের রাজধানী হাখাসহ দুটি টাউনশিপের পতনও এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এ দুই রাজ্যে জান্তার পূর্ণ পতনের সঙ্গে রাখাইন রাজ্যের স্বাধীনতার সম্ভাবনাও বাড়তে থাকবে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক উইলসন সেন্টারের মিয়ানমার বিশেষজ্ঞ ইয়ে মিয়ো হেইন বলছেন, ‘আরাকান আর্মির এখনকার নিশানা মিয়ানমার জান্তাকে রাখাইন থেকে তাড়ানো। তারপর যখন রাজনৈতিক ভবিষ্যতের প্রশ্ন আসবে, তখন তারা সব সম্ভাবনাই টেবিলে রাখবে। রাখাইনে নতুন, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও এর বাইরে থাকবে না।’ একই মত ব্যক্ত করেছেন ‘ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি ইন মিয়ানমার’ থিঙ্কট্যাঙ্কের রাজনৈতিক বিশ্লেষক অং থু নেইন। তাঁর মতে, আরাকান আর্মি আজ পর্যন্ত দাপ্তরিকভাবে ‘কনফেডারেশন স্ট্যাটাস’ চাইছে; কিন্তু কাল কী ঘটবে কেউ জানে না (ডয়চে ভেলে, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪)।

আমার ক্ষুদ্র পর্যবেক্ষণ মতে, প্রাচীন আরাকানের অভিন্ন অংশ রাখাইন ও চিন স্টেট যদি একসঙ্গে বা আলাদাভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। চিন স্টেটের ছয়টি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গত বছর ডিসেম্বরে গঠিত ‘চিন ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ ইতোমধ্যে আরাকান আর্মির সঙ্গে সমঝোতা ও সহযোগিতার ভিত্তিতেই জান্তাবিরোধী অভিযান চালাচ্ছে। যে কারণে চিন স্টেটের পালেটওয়া টাউনশিপ আরাকান আর্মি দখলে নিলেও তারা প্রতিবাদ করেনি। যদি রাখাইন স্টেট স্বাধীনতা চায়, চিন স্টেট বসে থাকবে কোন দুঃখে?
প্রশ্ন হলো, স্বাধীন বা আধাস্বাধীন রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ কী? রাখাইনের অন্তত ৮টি টাউনশিপে জনসংখ্যার দিক থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সংখ্যাগুরু বা সমানে সমান ছিল: মংডু, বুথিডং, রাথিডং ও সিত্তয়ে বা প্রাচীন আকিয়াব বন্দর। এর বাইরে আরও চারটি টাউনশিপে, রাখাইন স্টেটের মিনবিয়া, ম্রাউক-উ, চ্যাকট্য এবং চিন স্টেটের পালেটওয়ায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রোহিঙ্গা বসতি ছিল।

নব্বইয়ের দশক থেকে, বিভিন্ন পর্যায়ে সাম্প্রদায়িক ও রাষ্ট্রীয় সহিংসতার শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিতে থাকে। বিশেষত ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার সামরিক জান্তা ও রাখাইন উগ্রপন্থিদের যৌথ গণহত্যার মুখে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। অপর একটি অংশ, বিশেষত সিত্তয়ে তথা আকিয়াবের উদ্বাস্তু শিবিরে বন্দি হয়। এখনকার হিসাব হচ্ছে, মোটামুটি ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরে এবং ৬ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা রাখাইনের মংডু, বুথিডং, রাথিডং ও সিত্তয়ে টাউনশিপে নিজেদের বসতি বা আশ্রয়শিবিরে রয়েছে। ওদিকে তাদের বসতি, আবাদি জমি, ব্যবসা ক্রমেই সামরিক জান্তা, আরাকান আর্মি ও উগ্রপন্থি রাখাইনদের দখলে চলে গেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, সীমান্তের উভয় পাশের রোহিঙ্গাদের নিয়ে আরাকান আর্মির অবস্থান কী? রাখাইনে চূড়ান্ত ও একক ক্ষমতা হাতে পাওয়ার পর তারা রোহিঙ্গাদের নিয়ে কী করবে? প্রত্যাবর্তন মেনে নেবে, বসতি ও ক্ষেতখামার ফিরিয়ে দেবে? নাগরিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে? প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তর নয়।

এটি ঠিক, রাখাইন পুরোটা দখলে নেওয়ার আগ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের অধিকার ও প্রত্যাবর্তন বিষয়ে আরাকান আর্মি ইতিবাচক কথা বলে এসেছে। সংগঠনটির খোদ সামরিকপ্রধান তোয়াই ম্রাত নাইং বলেছেন, ‘আমরা রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকার স্বীকার করি; বাংলাদেশের সঙ্গে এ বিষয়ে আমরা কাজ করতে আগ্রহী; যেহেতু আমরা একক প্রতিপক্ষ হিসেবে বার্মিজদের বিরুদ্ধে, সে কারণে আরাকানে সবাইকে একসঙ্গে রাখতে চাই; রোহিঙ্গা সমাজ যদি আসতে চায়, আসুক, আমরা এই প্রত্যাবর্তনের বিরুদ্ধে নই’ (সাক্ষাৎকার, প্রথম আলো, ৫ জানুয়ারি ২০২২)। কিন্তু রাখাইনে জান্তার শক্তি যত কমেছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন বিষয়ে আরাকান আর্মির যদি-কিন্তু-তবে তত বেড়েছে।

যেমন, সম্প্রতি এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে সেই একই জেনারেল নাইং অনেক পুরোনো কথায় হাত দিয়েছেন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের পক্ষ হয়ে রোহিঙ্গারা ‘রাখাইনদের বিরুদ্ধে’ কী করেছিল; পঞ্চাশের দশকে বার্মার প্রধানমন্ত্রী উ নু কীভাবে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে’ তাদের নাগরিকত্ব দিয়েছিল; সামরিক জান্তা এখন কীভাবে তাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উস্কে দিয়েছে; আরসা ও আরএসও কীভাবে ‘সন্ত্রাসী’ কার্যক্রম চালাচ্ছে, ইত্যাদি (ইরাবতী নিউজ, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪)।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে জেনারেল নাইং বলেছেন, বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা যেভাবে বুথিডং ও মংডুতে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপে নিরাপদ অঞ্চল সৃষ্টির দাবি জানাচ্ছে, সেটি বাস্তবসম্মত নয়। তাঁর মতে, ওই দুই এলাকা “ঐতিহাসিকভাবেই আমাদের পূর্বপুরুষের ভূমি বিবেচিত। মুসলিমরা সেখানে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকে বাস করছে এবং তাদের উপস্থিতি কেবল ‘শান্তিপূর্ণ ও অনুগত’ সহাবস্থানের মাধ্যমেই অব্যাহত থাকা উচিত। আমরা এসব এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে দিতে পারি না”। সেপ্টেম্বরের পর রাখাইন কার্যত সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে পাওয়ার পর আরাকান আর্মির এই অবস্থান শক্তিশালী বৈ দুর্বল হয়নি।

দুঃখজনকভাবে, আগে তো বটেই, ২০১৭ সালের পর থেকেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ সরকার গৃহীত নীতি ও কৌশল ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। ‘মানবতা’ প্রদর্শনে সীমান্ত খুলে দেওয়া, বেইজিংয়ের মধ্যস্থতায় ঢাকা-নেপিডো প্রত্যাবাসন চুক্তি, নিরাপত্তা অজুহাতে রোহিঙ্গা সংগঠনগুলোকে ‘বসিয়ে’ রাখা, দিল্লির দাওয়াই মতে আরাকান আর্মির সঙ্গে দূরত্ব রাখা, পালিয়ে আসা জান্তা সেনাদের ধরে রেখে

দরকষাকষির বদলে জামাই আদরে ফিরিয়ে দেওয়া– সবই বাংলাদেশের জন্য ‘ব্যাকফায়ার’ করেছে।
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে পট পরিবর্তনের পরও রোহিঙ্গা ও রাখাইন প্রশ্নে ঢাকার পরিস্থিতি তথৈবচ। গত ১৯ ডিসেম্বর থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত পরামর্শ সভায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ‘ব্যাপক রোডম্যাপ’ তৈরির আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করে এসেছেন মিয়ানমারের কাছে! এখন, নেপিডোর নিজেরই যেখানে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা; রাখাইন ও রোহিঙ্গা নিয়ে তাদের রোডম্যাপে কী যায় আসে?
বিলম্বে হলেও ঢাকাকে বুঝতে হবে, স্বাধীন রাখাইনের প্রশ্নে বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর। কারণ, রাজ্যটির সঙ্গে বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো আন্তর্জাতিক সীমান্ত নেই। রাখাইন প্রশ্নে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র– যারাই যে অবস্থানই গ্রহণ করুক, বাংলাদেশই একমাত্র ভৌগোলিক করিডোর। স্বাধীনতা চাইলে আরাকান আর্মিরও বাংলাদেশকে ছাড়া গতি নেই। এখনকার পরিস্থিতি যদি বাংলাদেশ কাজে লাগাতে না পারে; যদি আগের মতো হিতোপদেশ দিয়ে যেতে থাকে; তাহলে কখনোই রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন সম্ভব হবে না।

রাখাইনে মিয়ানমার জান্তার পতনের পর সেখানকার যে সম্প্রদায় যত ‘গায়ের জোর’ দেখাতে পারবে, ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক বন্দোবস্তে তাদের ‘স্টেক’ তত বড় হবে। এই সত্য রোহিঙ্গারাও নিশ্চয় জানে। মনে রাখতে হবে, প্রতিটি খেলার নিজস্ব নিয়ম আছে। রাখাইন ঘিরে ভূ-রাজনীতিতে যখন হাডুডু খেলা চলছে, তখন বাংলাদেশ দাবার ছক নিয়ে বসে থাকলে আখেরে আবারও পস্তাতেই হবে।

 

শেখ রোকন: লেখক ও নদী গবেষক


সংবাদটি শেয়ার করুন....



আমাদের ফেসবুক পেজ