চায়না শেখ, মাদারীপুর প্রতিনিধি
ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর বাকী মিয়ার খুঁটির জোর কোথায়? বিগত ৩ যুগ ধরে তিনি ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে তাঁতিদের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়া তন্তবায় সমবায় সমিতির স্থাপনা এবং ৩০ কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি ১ কোটি ৭০ লাখ টাকায় বিক্রি করে ব্যাংক হিসাবে জমা দেন নাই। দি মাদারীপুর সাব-ডিভিশন কো-অপারেটিভ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইউনিয়ন লিমিটেড’ নামের এ অভিযোগ সমিতির পকেট কমিটির সভাপতি হাজী আবদুল বাকী মিয়া ঘটনার মূল হোতা। তার সকল অপকর্মে সহযোগিতা করেছেন রাজৈর উপজেলার বদরপাশা ইউনিয়নের তন্তবায় সমবায় সমিতির পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বাচ্চু।
ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগ সরকারের দাপট খাটিয়ে এই দুর্নীতী করা হয়েছে বলে মাদারীপুর তন্ত্ববায় সমবায় সমিতির ভুক্তভোগি তাঁতিরা জানান। ফলে মাদারীপুর জেলার তাঁতি সম্প্রদায়ের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। বিষয়টি নিয়ে অসহায় তাঁতিরা বিভিন্ন সময় প্রতিবাদ মিছিল, মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদান, প্রশাসনসহ দুদকে লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোন প্রতিকার পায়নি। ফলে জেলার ৩ হাজার তাঁতি পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বাকী মিয়া রাজৈরের টেকেরহাট এলাকার মৃত লাল চাঁন মিয়ার ছেলে। ভূক্তভোগী তাঁতিরা জানান, ১৯৪৮ সালে মাদারীপুর পুরানবাজার রেইন্ট্রিতলায় দি মাদারীপুর সাব-ডিভিশন কো-অপারেটিভ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইউনিয়ন লিমিটেড’ নামে তন্ত্ববায় সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন তাদের পূর্বপুরুষেরা তাদের উপার্জিত টাকা দিয়ে ৬৯ শতাংশ জায়গা ক্রয় করে আধাপাকা অবকাঠামো নির্মাণ করেন।
বিগত ১৯৮৮ সালে রাজৈর উপজেলার টেকেরহাটের আবদুল বাকী মিয়া সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। তিন বছর মেয়াদি এ কমিটির মেয়াদ শেষ হলেও তার আপন মেজো ভাই রুহুল আমীন বেপারি সভাপতি হন। তার মেয়াদ শেষে কৌশলে তারই আরেক আপন ছোট ভাই মো. হাবিবুর রহমানকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। সর্বশেষ একই কায়দায় সাবেক সভাপতি বাকী মিয়া পুনরায় সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ঘুরে ফিরে একই পরিবারের মধ্যে আপন তিন ভাই সভাপতি নির্বাচিত হয়ে আসছেন। আর এভাবে কেটে গেছে একে একে ৩২ বছর। সভাপতি থাকাকালীন বাকী মিয়া ২০১৬ সালে পরিবারের অন্য সদস্যদের (নিকটাত্মীয়) নিয়ে একটি পকেট কমিটি গঠন করেন এবং একে অপরের যোগসাজশে ৬০ শতাংশ জায়গা মাদারীপুরের প্রভাবশালীদের কাছে বিক্রি করে টাকা সমিতির ব্যাংক হিসাবে জমা না দিয়েই তা আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ করেন তাঁতিরা।
এ আত্মসাতের ঘটনা প্রকাশ পেলে তাঁতি সম্প্রদায় তীব্র প্রতিবাদ জানান। এক পর্যায়ে সভাপতি আবদুল বাকী মিয়া টেকেরহাটে তার নিজস্ব ৬ শতাংশ জায়গা সমিতির নামে দলিল করে দিয়ে ওই জায়গায় অফিস নির্মাণ করেন। এখানেও তিনি জালিয়াতির আশ্রয় নেন। তাঁতিদের লিখিত অভিযোগ অনুসন্ধান করে জানা গেছে, বিগত ১৯৪৮ সালের ২৭ জুলাই প্রতিষ্ঠিত হয় এই প্রতিষ্ঠান। যার রেজি নং-৩২৮। বাকী মিয়া তৎকালীন হাসিনা সরকারের দোসর জেলা সমবায় কর্মকর্তাগণ এবং তার পরিবারের সদস্যদের যোগসাযোসে বিপুল অর্থের বিনিময়ে নিয়ম বর্হিভূতভাবে ২০১৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় সমিতির ৬৯ শতাংশ জমির মধ্যে ৬০ শতাংশ জমি এবং আধাপাকা স্থাপনা বিক্রি করে দেন। তৎকালিন বাজার মূল্য প্রায় ৩০ কোটি টাকার সম্পত্তি মাত্র ১ কোটি ৭০ লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন বলে জানান সমিতির বঞ্চিত নেতারা।
এই ঘটনা সমিতির অন্যান্য কর্মকর্তা ও সদস্যগণ জানতে পেরে বাকী মিয়ার কাছে পূর্বের হিসাবের খাতাপত্র দেখতে চায়। কিন্তু তিনি আজ কাল করে বহুবার হিসাব দেওয়ার কথা বললেও তা অদ্যাবধি দেন নাই। এ অবস্থায় সমিতির সদস্যগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ২০১১ সালের ৩ নভেম্বর তার বাড়ি ঘেরাও করেন এবং রাজৈর উপজেলা নির্বাহী অফিসের সামনে বিচারের দাবীতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। বিষয়টি বিভাগীয় সমবায় কার্যালয়, ঢাকা হতে তদন্ত হলে ব্যাপক অনিয়ম ধরা পড়ে। এছাড়াও মাদারীপুর সমবায় কার্যালয় হতে ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরের অতিষ্ট হয়। অডিট রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, জমি বিক্রয় এর জন্য যে আবেদন করেছিল। অনুমতি না পাওয়া সত্ত্বেও সমিতির অর্থ আত্মসাৎ করার লক্ষে সভাপতি বাকী মিয়া ২০১৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি দলিল নং ৯৪৫/১৬ জমির পরিমান ৬০ শতাংশ বিক্রি করে এবং বিক্রিত অর্থ সমিতির কোন ব্যাংক হিসাবে জমা করেন নাই। অডিটে জায়গা বিক্রির অনিয়ম এবং টাকা আত্মসাতের সত্যতা খুঁজে পায়।
পরে তিনি টেকেরহাট তার নিজের ৬শতাংশ জায়গা বেশি দামে সমিতির নামে ক্রয় করেন এবং এখানেও তিনি কোন নিয়ম-নীতি তোয়াক্কা করেননি যা অডিট রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তীতে ৰাকী মিয়ার বিরুদ্ধে বিভাগীয় সমবায় কার্যালয় ঢাকা হতে গত ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর ১২ লাখ ৩৮ হাজার ৬৯২ টাকা দায় দেনা ধার্য করা হয় এবং টাকা জমা দেয়ার জন্য ৩ মাস সময় দেওয়া হয়। সময় অতিবাহিত হওয়ার পরেও টাকা জমা না দিয়ে বাকী মিয়া অসৎ উদ্দেশ্যে বিভাগীয় সমবায় কার্যালয়, ঢাকার সচিব এবং উর্ধতন সমবায় কর্মকর্তা, মাদারীপুর জেলা প্রশাসক, জেলা সমবায় কর্মকর্তাসহ ৮জনকে বিবাদী করে মাদারীপুর আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। ( মামলা নং ৩/২৩, তারিখ ০৩.০১.২০২৪)। বর্তমানে মামলাটি আদলতে চলমান।
মামলা নিষ্পত্তির ব্যাপারে জেলা সমবায় অফিস থেকে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় তাঁতিদের মধ্যে ক্ষোভের দানা বাধছে। এ ব্যাপারে সমিতির বর্তমান সভাপতি বাকী মিয়ার মেজো ভাই রুহুল আমীন বেপারি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, “বিষয়টি নিয়ে খুব শীঘ্রই সকলকে নিয়ে বসে নিষ্পত্তি করা হবে।” অভিযুক্ত হাজী আব্দুল বাকী মিয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মাদারীপুরে নিহতের ঘটনায় মামলার আসামী হওয়ায় পলাতক থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। এ ব্যাপারে মাদারীপুর জেলা সমবায় কর্মকর্তা জয়ন্তী অধিকারী বলেন, ‘তাঁতিদের অভিযোগের ভিত্তিতে বিভাগীয় সমবায় কার্যালয় ঢাকা তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্তে ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়। এছাড়াও মাদারীপুর সমবায় কার্যালয় হতে ২০১১-২০২০ অর্থ বছরের অডিট হয়। সেই অডিটেও ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে বাকী মিয়া কর্তৃ পক্ষের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন। মামলাটি আদালত থেকে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আমরা কোন মন্তব্য করতে পারিনা।